এক বিশ্বজিৎ বনাম একুশ ছাত্রলীগ


মনিরুজ্জামান :: এক বিশ্বজিৎ চলে গেল, নিয়ে গেল একুশ তাজা তরূণকে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী একুশ জন ছাত্রের নামে হত্যাকান্ড ঘটনায় জড়িত থাকায় চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। এতে আইনের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা বাড়বে।
নিরাপত্তা বোধ করবে এই ভেবে যে, সুষ্ঠু বিচার হবে। কিন্তু এ ঘটনার অন্তরালে কতগুলো জীবন নষ্ট হল তা অজানাই রয়ে গেল।
গত বছর ৯ ডিসে¤রর জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালরেয়র উপর দিয়ে একটি মোটামুটি ঝড় বয়ে গেছে। অবরোধে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রাইসাবাজারে বিশ্ববিজৎ দাস অবরোধ বিদ্রোহীদে হাতে নির্মমভাবে খুন হয়। আর হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত ছাত্রলীগ একুশ শিক্ষার্থী। তারাও অন্য সবার মত একটি পরিবার থেকে এসেছে। তাদের বাবা-মা অন্য সবার বাবা-মার মতই ভালোবাসে। তাদের ঘিরে ছিল একরাশ আশা।
সব ভেস্তে গেল ছাত্রলীগের কাল থাবায়। বলা হয় তারা প্রত্যেকে ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন। সেদিন কেন তারা খুণ করল? বিরোধী দলের ডাকা আবরোধে ছাত্রলীগকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছিল কারা? অবরোধে বিদ্রোহ করার নির্দেশ দিয়েছিল কারা? ডিসেম্বর এর শুরু থেকে ছাত্রলীগ প্রত্যেকটা শাখায় নিয়মিত হানা হানির ঘটনা ঘটে আসছিল। প্রত্যেকদিন কোথাও না কোথাও শিবির গণোধোলাই খাচ্ছিল। এ ঘঠনায় বাহবা দিচ্ছিল কারা? বাহবা পাওয়ার আশায় রাজনৈতিক পদ পাওয়ার মিথ্যা আশায় সেদিন অবরোধ বিদ্রোহ করে অবস্থান নিয়েছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরূন। পাশেই ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাল অবরোধকর্মীরা। তাতে আতংকিত জনগন ছোটাছুটি করছিল চারপাশে।
ছাত্রলীগ মারমুখি ভাবে তাড়া দিয়ে সন্দেহাতীত ভাবে বিশ্বজিৎকে নির্মম ভাবে কুপিয়ে, পিটিয়ে হত্যা করল। প্রশ্ন: খুনিদের কি শাস্তি হবেনা? অবশ্যই শাস্তি হবে। প্রকৃত দোষীদের অবশ্যই কঠিন শাস্তি হবে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধি কত জন? দুই জন? পাঁচ জন? দশ জন? পনের জন? তাই বলে একুশ জন হলে তা বেশি হয়ে যেতে পারে। যাদের দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে তারা মাছের বাজারের পণ্য নয় যাকে খুশি তাকে তালিকায় ভরে দিলাম। কঠিন প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষায় উত্তির্ণ হয়ে ভর্তি হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারা অবশ্যই শিক্ষিত এবং মেধাবী। তাদের একুশ জনের নামে চার্জশিট দাখিল হয়েছে কিন্তু ধংষ হয়েছে আরও বেশি মেধাবীর জীবন। চলার পথ থেকে ছিটকে পড়েছে আরও অধিক। হত্যাকান্ড ঘটনা ঘটার পর রাজসাক্ষি ছিল সাংবাদিকদের তোলা ভিডিও ফুটেজ এবং ছবি। আর তাই অবলম্বন করে টপাটপ খুনি বানিয়ে দেওয়া হল।
ককটেল বিস্ফোরণে ছাত্রলীগের সবাই সেখানে গিয়েছিল। কিন্তু সবাইতো খুন করতে যায়নি! রাজনৈতিক বড় ভাইদের মন রক্ষা করতে অনেকেই গিয়েছিল সেখানে। এত মানুষের মাঝে খুন হল বিশ্বজিৎ। তাই বলে কি যার ছবি, ফুটেজ এ আছে সেই খুনি? কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাই করেছে। এক দিন এক পত্রিকায় কয়েকজনের ছবি আসছে আর টপাটপ তাকে স্থায়ী বহিষ্কার করে খুনি বানিয়ে দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আতংক ছড়িয়ে গেল, পত্রিকায় ছবি আসবে যার সেই খুনি। এ আতংকে ভীত সশস্ত্র ছাত্রলীগ কর্মীরা যে যেভাবে পারল আত্মগোপন করল।
ঘটনা ঘটল ৯ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের সকল সংবাদমাধ্যম ফলাও করে প্রকাশ করতে লাগল খুনের ভিডিও এবং ছবি। যার কাছে যত ছবি, ভিডিও ছিল ফেসবুক, টুইটার এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম অবলম্বনে প্রকাশ করতে থাকল। ১২ডিসেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি মেইল পাঠালো এই ভাবে,
‘‘গত ০৯ ডিসেম্বর, ২০১২ তারিখ (বরিবার) সকালে ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ চলাকালীন সময়ে পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সন্নিকটে নিরীহ টেইলারিং ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ দাস নিহত হওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এবং জাতীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ও  ছবির আলোকে এবং অদ্য ১২ ডিসেম্বর বেলা ১টায় বিশ্ববিদ্যালয় আইন শৃঙ্খলা কমিটি ও প্রক্টোরিয়াল বডির জরুরী সভায় প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে প্রাক্তন দুজন ছাত্রের সনদ বাতিল এবং তিনজন ছাত্রকে বহিস্কার করা হয়েছে।’’
রিপোর্ট করার ক্ষাতিরে প্রক্টর স্যারকে ফোন দিলাম। আসলে স্থায়ী নাকি সাময়িক বহিষ্কার জানতে চেয়েছিলাম। স্যার বললেন, অবশ্যই স্থায়ী ভহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু, প্রশ্ন হল; কোন তদন্তের ভিত্তিতে সেদিন বহিষ্কার করা হল? পত্রিকাগুলো আবার ছাপতে লাগল বহিষ্কারের খবর। তারপর একের পর এক পত্রিকা ছাপতে লাগল হত্যাকান্ডের আরও নতুন ছবি। সেখানে আসতে লাগল আরও নতুন মুখ।
২০ ডিসেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারে জড়িত থাকার অভিযোগে আরো চার জন ছাত্রকে স্থায়ী বহিস্কার করা হল। আবার কোন তদন্ত করে চারজনকে বহিষ্কার করা হল? তাহলে আজ একুশ জনের নাম আসল কেন? নয় জনের নাম আসতে পারত। এতেও থেমে থাকলনা প্রচার প্রসার।
১০ ডিসেম্বর। পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আরও প্রাক্তন এক ছাত্রের সনদ বাতিল এবং  তিনজন ছাত্রকে  বহিস্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কোন দেশের তদন্ত কমিটি একই বিষয়ের উপর থেকে থেকে নতুন রিপোর্ট দেয় জানিনা।
আসলে কোন তদন্ত কমিটি নয়। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বিশ্বজিৎ এর আশেপাশে যার ছবি সম্বলিত ছবি পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে তাকে ধরে ধরে বলি দেওয়া হচ্ছে। এদিকে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য সুবিধা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যলয় থেকে বহিষ্কার মানেই সে সত্যিই খুন করেছে। চার্জশীটে তার নাম চলে আসবে। এমনটাই ভাবা হচ্ছে। তাই, ছবি আতংকে ক্যাম্পাস ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। আর যারা পালিয়েছে তাদের নামের পেছনে পলাতক শব্দটা জুড়ে দিয়েছে পত্র-পত্রিকাগুলো। চার্যশীট দাখিল হওয়ার পরে দেখা যায় ছবি আসছিল অনেকের নামেই চার্যশীট হয়নি। কিন্তু তার জীবনের তিনটি মাস কে ফিরিয়ে দেবে? তার নাম থেকে পলাতক শব্দটি কে মুছে দিবে? হয়ত অনেকেই মুক্তি পাবে একদিন। কিন্তু তাদের জীবনটা ধংস হয়ে যাওয়ার পর।
সঠিক তদন্ত না করে পত্র-পত্রিকায় ছবির সূত্র ধরে চার্যশীট গঠন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের তৃণমূল কর্মীরা। হত্যাকান্ডে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা নেই এমন অনেকেই আজ খুনের আসামি। আবার সংশ্লিষ্টতা থাকলেও ছবি বা ভিডিও ফুটেজ থেকে পরিচয় সনাক্ত করতে না পারায় চার্যশীটের তালিকা থেকে বাদ গেছে কয়েকজন খুনির নাম। এমন অভিযোগ করেছে বেশ কয়েকজন ছাক্রলীগ কর্মী। তাহলে কিসের তদন্ত করা হল? ছবি বা ভিডিও ফুটেজ না থাকলে কি প্রকৃত খুনিদের বের করা যেতনা? মনে হয়, না।
ছাত্রলীগ না করলে এরা কেউ খুন করত না এ কথা সহজেই ভাবা যায়। তাহলে খুনের পেছনে দায়ী ছাত্রলীগ নামক সংগঠন? উত্তর: না। ছাত্রলীগকে পরিচালনার ব্যর্থতা। আজ একুশজন তরুণের জীবনের চরম পরিচয়ের মাধ্যমে তা আবার প্রমানিত হল।

সূত্র: ইউকেবিডি ডটকম:: এক বিশ্বজিৎ বনাম একুশ ছাত্রলীগ
 

No comments:

Post a Comment