ক্যানসারের মতো মারণ রোগের বাড়বাড়ন্ত
ঠেকাতে প্রাচীন আয়ুর্বেদকেই এ বার হাতিয়ার করতে চাইছেন বিজ্ঞানীরা।
আমেরিকার ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এক দল বাঙালি বিজ্ঞানীর সাম্প্রতিক
গবেষণায় ধরা পড়েছে, ম্যালিগন্যান্ট টিউমার ছড়ানো রুখতে উল্লেখযোগ্য
ভূমিকা রয়েছে ত্রিফলা চূর্ণের। দীর্ঘ দিন নিয়মিত ত্রিফলা চূর্ণ সেবনে বেশ
কিছু ক্ষেত্রে ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব বলে তাঁরা দাবি করেছেন। মারণ রোগের
মোকাবিলার ক্ষেত্রে এই ত্রিশক্তির দাপটের বিষয়টি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক
সায়েন্স জার্নাল ‘প্লস ওয়ান’-এ প্রকাশিত হয়েছে।
ত্রিফলা অর্থাৎ আমলকী, হরীতকী আর বয়ড়া। কী তাদের ভূমিকা?
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, দেহে নতুন রক্তজালিকা বা ক্যাপিলারি সৃষ্টির
প্রক্রিয়াকে বলা হয় অ্যাঞ্জিওজেনেসিস। এর থেকেই অনেকাংশে ম্যালিগন্যান্ট
টিউমারের জন্ম হয়ে থাকে। অথবা আগে থেকে কোনও ম্যালিগন্যান্ট টিউমার থাকলে
তার বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেয় অ্যাঞ্জিওজেনেসিস প্রক্রিয়া। চিকিৎসার
পরিভাষায় যার নাম, ভাস্কুলার এন্ডোথেলিয়াল গ্রোথ ফ্যাক্টর। চিকিৎসকেরা
জানাচ্ছেন, রক্তজালিকার ওই বৃদ্ধি শুধু ক্যানসার নয়। রেটিনোপ্যাথি
(রেটিনার ক্ষয়) এবং এন্ডোমেট্রিওসিস (মহিলাদের এক ধরনের অসুখ, যা থেকে
বন্ধ্যাত্বও হতে পারে)-এর জন্যও দায়ী। ত্রিফলা এই রক্তজালিকা বৃদ্ধির
প্রক্রিয়াকেই রোধ করতে সাহায্য করে।
রক্তজালিকা বাড়ার সঙ্গে ক্যানসারের সম্পর্ক কী?
ক্যানসার
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন শরীরের যে গ্রন্থিতে ক্যানসার হয়, সেগুলিতে অতিরিক্ত
কোষ বিভাজনের ফলে টিউমার তৈরি হয়। কোষ বিভাজন যত দ্রুত হয়, তত বেশি করে
ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। টিউমারের কোষগুলিতে খাদ্য সরবরাহ করে
রক্তজালিকা। তাই টিউমার যত বড় হতে থাকে, ততই সংখ্যা বাড়ে রক্তজালিকারও। এ
বার ওই রক্তজালিকার সংখ্যা কোনও ভাবে কমিয়ে আনা গেলে টিউমারের কোষগুলিতে
রক্ত সরবরাহ কমে যায়। ফলে ওই কোষগুলি তখন আর পর্যাপ্ত অক্সিজেন এবং খাদ্য
পায় না। তাই এক সময় ওরা মরে যায়। রক্তজালিকার বাড়বৃদ্ধি আটকে দিয়ে
টিউমারের কোষগুলো মেরে ফেলার এই কাজটাই করে ত্রিফলা।
বর্তমানে অ্যাঞ্জিওজেনেসিস আটকানোর জন্য ওষুধ বাজারে রয়েছে ঠিকই। সেটা
প্রথমত বেশ দামি। ক্যানসার চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, ইঞ্জেকশনটির একটি কোর্স
শেষ করতেই খরচ হয় লক্ষাধিক টাকা। দ্বিতীয়ত, ওই ওষুধ চিকিৎসকেরা সচরাচর
ব্যবহার করতে চান না। কারণ ওষুধটির নিজেরই টক্সিক এফেক্ট (এক ধরনের
বিষক্রিয়া) রয়েছে। তা ছাড়া এর কার্যকারিতাও ২০ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি
নয়। তা সত্ত্বেও বাঁচার আশায় অনেকে সর্বস্বান্ত হয়েও ওই চিকিৎসার
ব্যবস্থা করেন।
ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে বাঙালি বিজ্ঞানীদের যে দলটি ত্রিফলার গুণ
নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে, সুজিত বসু তার প্রধান। ওহায়ো-তে তাঁর সহযোগী
গবেষকরা হলেন দেবাঞ্জন চক্রবর্তী এবং চন্দ্রাণী সরকার। সুজিতবাবু বলেন,
“বিজ্ঞানের এত উন্নতি সত্ত্বেও ক্যানসার রোগটাকে কোনও ভাবে কব্জা করা
যাচ্ছে না। এই হতাশা আমাদের সকলের। তবে ত্রিফলার গুণ আমরা প্রমাণ করতে
পেরেছি।” ইতিমধ্যেই ইঁদুরের দেহে সেটা সফল ভাবে পরীক্ষা চালিয়ে দেখাও
হয়েছে। কী রকম? প্রথমে ইঁদুরের দেহে মানুষের দেহের ক্যানসারবাহী টিউমার
কোষ প্রবেশ করানো হয়। তার পর সেই ইঁদুরকে প্রতি দিন ১০০ মিলিগ্রাম করে
ত্রিফলা চূর্ণ খাওয়ানো হতে থাকে। সুজিতবাবুর দাবি, “ত্রিফলার প্রভাবে ওই
ইঁদুরের দেহে পাকস্থলীর ক্যানসার, লিম্ফোমা এবং প্যাংক্রিয়াসে ক্যানসার
ছড়িয়ে পড়া আটকানো গিয়েছে।” অথচ ইঁদুরের দেহের অন্য কোনও অংশে
উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন কিংবা ন্যূনতম বিষক্রিয়াও প্রমাণিত হয়নি বলে জানান
তিনি।
অ্যাঞ্জিওজেনেসিস কী? |
দেহে নতুন রক্তজালিকা তৈরির প্রক্রিয়া, যা ম্যালিগন্যান্ট টিউমার তৈরি করে বা ইতিমধ্যেই থাকা ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেয়। |
ক্যানসার ঠেকাতে ত্রিফলার কার্যকারিতার
খবরে যারপরনাই উত্তেজিত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকেরাও। তাঁদের বক্তব্য, যুগ যুগ
ধরে এই তিনটি ফলের উপকার পেয়ে আসছেন। পেটের নানা রোগ সারাতে তো বটেই,
হার্টের সমস্যা দূর করতেও ত্রিফলার গুণ প্রমাণিত। আয়ুর্বেদ চিকিৎসক
অমলকান্তি ভট্টাচার্য বলেন, “নতুন কিছু বলেননি ওঁরা। চরক সংহিতাতেই লেখা
রয়েছে ত্রিফলা হল ত্রিদোষ অর্থাৎ বায়ু, পিত্ত, কফের যাবতীয় সমস্যা নাশক।
দুঃখের বিষয়, বিদেশ থেকে সার্টিফিকেট না দিলে এখানে কেউ কদর করে না।” একই
কথা আয়ুর্বেদ চিকিৎসক মৃণালকান্তি ত্রিপাঠীরও। তাঁর দাবি, “প্রতিদিন খালি
পেটে ত্রিফলা ভেজানো জল বা এক চামচ ত্রিফলা চূর্ণ নবজন্ম দিতে পারে।”
No comments:
Post a Comment